কক্সবাজার প্রতিনিধি || কক্সবাজারের টেকনাফ শিলখালী গ্রামের কৃষক হাসান শরীফের রয়েছে এক একর জমিতে সুপারির বাগান। সমুদ্র থেকে বয়ে আসা লবণাক্ত বাতাস, অনিয়মিত বৃষ্টি আর অতিরিক্ত গরমে তার সেই বাগান একসময় প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়েছিল। গাছের আগা পুড়ে ও পাতা ঝড়ে পড়ায় সুপারির ফলন ছিল খুবই কম। তবে, এবারের মৌসুমে দৃশ্যটা সম্পূর্ণ উল্টো। তার জমির সারি সারি গাছে ঝুলছে সুপারি। কাঙ্খিত ফলন পাওয়ায় হাসান শরীফের মুখে এখন সন্তুষ্টির হাসি।
এই চাষি বলেন, “আগে বুঝতাম না আবহাওয়া কেমন প্রভাব ফেলে। কৃষি অফিসের পরামর্শে এখন পানি নিষ্কাশন, ছায়া তৈরি, জৈব সার আর আগাছা নিয়ন্ত্রণ করছি। গাছ এখন শক্ত, ফলন দ্বিগুণ হয়েছে। ২০ শতকের একটি বাগান থেকে এবার প্রায় দেড় লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করেছি।”
টেকনাফের শামলাপুর বাজারের ক্রেতা শাহজালাল বলেন, “এখন বাজারে ৮০টি সুপারি ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমরা বাগান থেকে একটু কম দামে সংগ্রহ করে শুকানো ও পরিবহন খরচ হিসাব করেও ভালো লাভ রাখতে পারি। কক্সবাজারের এই সুপারি এখন দেশের নানা জেলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।”
শনিবার (২৫ অক্টোবর) সরেজমিনে উখিয়া-টেকনাফের উপকূলীয় এলাকার কয়েকটি সুপারি বাগান ঘুরে দেখা যায়, পরিবর্তনের এক অনন্য দৃশ্য। বাগানগুলো এখন সবুজের সমারোহ। সারি সারি গাছে ঝুলছে কমলার মতো বড় আকারের সুপারি। বাতাসে ভেসে আসছে সুপারির গন্ধ। লবণাক্ততার দুর্ভোগ পেরিয়ে সুপারি চাষিরা এখন স্বপ্ন দেখছেন নতুন সম্ভাবনার।
উখিয়ার সোনারপাড়ার আব্দুল মোনাফ, পাটোয়ারটেক এলাকার সৈয়দ হোসেন ও টেকনাফের জাহাজপুরা এলাকার ইরফান আজাদসহ অনেক চাষি এখন আবহাওয়া বুঝে পরিকল্পিত সুপারি চাষ করছেন।
জাহাজপুরা এলাকার ইরফান আজাদ বলেন, “প্রতি মৌসুমে প্রায় ১৬০ শতক জমি থেকে কাঁচা, শুকনো এবং ভেজা সুপারি বিক্রি করে আমাদের পরিবারের আয় হয় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা। আগে বন্যা ও জোয়ারের পানি প্রবেশ বা সমুদ্র থেকে বয়ে আসা লবণাক্ততার কারণে ফলন কমে যেত। বাতাসের কারণে অনেক সময় সুপারি গাছের আগা ভেঙে যেত। এখন উপকূলে ঝাউবিথী রোপণের কারণে বাতাস আর লবণাক্ততার ধাক্কা ঝাউ গাছে লাগে। এ কারণে সুপারি বাগানের গাছগুলো সবল ও স্বাস্থ্যবান আছে এবং দারুন ফলন দিচ্ছে।”

বিক্রি করতে বাজারে ইজিবাইকে করে সুপারি আনছেন বিক্রেতারা
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে সুপারি সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়েছে। আমার বড় চাচা এরশাদুর রহমান ৪ দশমিক ৮ একর জমিতে সুপারি গাছ লাগিয়ে প্রতি মৌসুমে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় করেন।”
ভালো ফলনের কারণ ব্যাখ্যা করে ইরফান আজাদ বলেন, “সুপারি বাগানে শুষ্ক মৌসুমে আলাদা মোটর পাম্পের মাধ্যমে পানি সেচ দেই। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বছরে দুইবার বিভিন্ন ধরনের সার প্রয়োগ করি। এভাবে নিয়মিত যত্নের ফলে দিন শেষে ভালো ফলন পেয়েছি। এতেই খুশি।”
সোনারপাড়ার আব্দুল মোনাফ বলেন, “আগে সুপারি গাছের পাতা শুকিয়ে যেত, কারণ মাটিতে লবণাক্ততা বাড়ত। এখন আমরা জৈব সার ব্যবহার করি, বাগানে বৃষ্টির পানি ধরে রাখি। গাছ সবুজ, ফল ভালো।”
অপর চাষি সৈয়দ হোসেন বলেন, “আমরা এখন মোবাইল কিংবা টেলিভিশনে আবহাওয়ার খবর দেখি। ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে আগেভাগে গাছ থেকে সুপারি নামিয়ে ফেলি। সুপারি ঝরে পরে নষ্ট হয় না, গুণগত মানও ঠিক থাকে।”
টেকনাফের শামলাপুর বাজারের ক্রেতা আবু সিদ্দিক বলেন, “কৃষকদের কাছ থেকে তুলনামূলক কম দামে কাঁচা বা শুকনো সুপারি কিনে আমরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও রাজশাহীর বাজারে সরবরাহ করি। সেখানকার পাইকারি ক্রেতাদের কাছে এই সুপারির চাহিদা অনেক বেশি, কারণ উপকূলের মাটিতে উৎপাদিত সুপারি শক্ত ও টেকসই হয়। প্রতি মৌসুমে এভাবেই ভালো মুনাফা করা যায়।”
আবহাওয়া-সহনশীল পরিচর্যায় সফল পদ্ধতির পরামর্শ:
টেকনাফ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির জানান, বর্তমানে টেকনাফ উপজেলায় প্রায় ১,২৬০ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হচ্ছে। কাঁচা অবস্থায় খোসাসহ প্রতি হেক্টরে গড় ফলন ১৮ থেকে ২০ মেট্রিক টন পর্যন্ত হয়। খোসা ছাড়ানো শুকনো সুপারি মেলে প্রায় ৫ থেকে ৭ মেট্রিক টন।

সুপারি কিনতে বাজারে ক্রেতাদের ভিড়
বাজারে এক পন বা ৮০টি সুপারি গড়ে ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবছরই নতুন করে ৫ থেকে ১০ হেক্টর জমি সুপারি চাষের আওতায় আসছে, যা এই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে।
তিনি বলেন, “উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাব থেকে সুপারি বাগান রক্ষা করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য মাঠপর্যায়ে আমাদের কৃষি উপ-সহকারীরা নিয়মিত কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন কীভাবে সঠিক সার প্রয়োগ, বালাই দমন ও সেচ ব্যবস্থাপনা করলে গাছ সুস্থ থাকবে। আমরাও কৃষকদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, যাতে তারা জলবায়ু-সহনশীল পদ্ধতিতে আরো উন্নত মানের সুপারি উৎপাদন করতে পারেন। পাশাপাশি সুপারি চাষকে টেকসই ও লাভজনক করতে আমরা নতুন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালুর সুপারিশ পাঠিয়েছি।”
উখিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামনাশিস সরকার জানান, বর্তমানে উখিয়া উপজেলায় ৯৭৩ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হচ্ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রভাব মোকাবিলায় কৃষকদের কিছু সচেতন পদক্ষেপেই এখন ফলন বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, “এই অঞ্চলে বছরে কম-বেশি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সুপারি গাছ নষ্ট হতো। এখন সচেতন ব্যবস্থাপনার কারণে সেই ক্ষতি কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে।” কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, কিছু পদ্ধতি মেনে চললে সুপারি বাগান টেকসই হয়।
জেনে নেই কী সেই পদ্ধতি:
পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা: অতিবৃষ্টির পর পানি জমে থাকলে শিকড় পচে যায়। তাই জমিতে নালা বা ড্রেন রাখা জরুরি।
লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ: গাছের গোড়ায় খৈল, ছাই ও জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির ক্ষারত্ব কমে।
ছায়া ও বাতাসের ভারসাম্য: বাগানে কলা বা পেঁপে গাছ লাগালে লবণাক্ত বাতাসের প্রভাব কমে, আর্দ্রতাও বজায় থাকে।
মাটি ঢেকে রাখা: গাছের গোড়ায় শুকনো পাতা বা খড় বিছিয়ে রাখলে গরমে মাটির আর্দ্রতা নষ্ট হয় না।
সময়মতো ছাঁটাই ও পরিচ্ছন্নতা: পচা ডাল কেটে ফেলা ও আগাছা পরিষ্কার রাখলে গাছ সুস্থ থাকে এবং ফল বড় হয়।
কীভাবে চারা রোপণ ও সার প্রয়োগ করতে হবে:
টেকনাফ উপজেলার শামলাপুর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাক উদ্দিন বলেন, “উখিয়া ও টেকনাফের মাটি ও জলবায়ু সুপারি চাষের জন্য প্রাকৃতিকভাবে উপযুক্ত। তবে লবণাক্ত বাতাস ও বৃষ্টির অনিয়ম এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও এলাকার সচেতন চাষিরা প্রমাণ করছেন, নিয়ম মেনে চললে এই চ্যালেঞ্জও পরিণত হয় সম্ভাবনায়।”

সুপারি গণনায় ব্যস্ত বিক্রেতারা
তার মতে, “ভালো ফলন পেতে সুপারি গাছে সময়মতো ও সঠিকভাবে সার দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।”
এই কৃষি কর্মকর্তা জানান, চারা রোপণের সময় প্রতিটি গর্তের গভীরতা দেড় হাত রাখতে হবে এবং গর্তগুলোর মধ্যে দূরত্ব ৪–৫ হাত রাখা উত্তম। প্রতিটি গর্তে ৫–১০ কেজি পঁচা গোবর, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ৫০ গ্রাম এমওপি এবং সামান্য ডলুচুন মিশিয়ে ৭–১০ দিন অপেক্ষার পর চারা রোপণ করা উচিত। এর পর প্রতি বছর ১–৩ বছর বয়সী ছোট গাছে পঁচা গোবর ৫–১০ কেজি, ইউরিয়া ২০০ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম এবং এমওপি ১০০ গ্রাম দুই কিস্তিতে বর্ষার আগে ও পরে দেওয়া উচিৎ। চার বছর বা তার বেশি বয়সের গাছের জন্য এই পরিমাণের দ্বিগুণ, আর ১০ বছরের বেশি বয়সী গাছের জন্য ত্রিগুণ সার প্রয়োজন। ২–৩ বছর পর একবার প্রতিটি গাছের গোড়ায় অন্যান্য সারের সঙ্গে এক চা চামচ বোরণ দিলে সুপারি ফেটে যাওয়া কমে এবং ফলের আকার সুন্দর হয়।
কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাক উদ্দিন জানান, সার দেওয়ার সময় সবসময় গাছ থেকে ১.৫ হাত দূরে বৃত্তাকারে হালকা মাটি খুঁড়ে সার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে পানি দিতে হবে। সার দেওয়ার আগে ও পরে পানি দেওয়া এবং আগাছা পরিষ্কার রাখা জরুরি। এই নিয়ম মেনে চললে গাছ সবল থাকে এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। যে কোনো কৃষি বিষয়ক সাহায্যের জন্য নিকটস্থ উপসহকারী কৃষি অফিসার বা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
শুধু কক্সবাজারই নয়, যেকোন দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটিতেও সুপারির সম্ভাবনা:
সুপারি চাষ শুধু কক্সবাজারের উপকূলেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটির এলাকাগুলোতেও এই ফলন সমান সম্ভাবনাময়। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, যেখানে অতিরিক্ত পানি জমে না, মাটির নিচে আর্দ্রতা থাকে এবং সেচের সহজ ব্যবস্থা আছে সেসব অঞ্চলেও সুপারি চাষ সফলভাবে করা যায়। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ, জৈব সার ব্যবহার ও নিয়মিত সেচ ব্যবস্থাপনা বজায় রাখলে দোআঁশ মাটিতেও গাছ শক্তভাবে বেড়ে ওঠে এবং ভালো ফলন দেয়। আবহাওয়া সহনশীল এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে সুপারি হতে পারে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল থেকে শুরু করে সমতল মধ্যাঞ্চলের কৃষকদের নতুন আয়ের উৎস।
আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যেও আশার আলো:
বিশেষজ্ঞ রফিক উল্লাহ বলেন, “সুপারি গাছ ভূমিধস রোধ করে, মাটির ক্ষয় কমায় এবং দীর্ঘমেয়াদে কার্বন ধারণেও সহায়ক। ফলে এটি শুধু অর্থকরী ফসল নয়, আবহাওয়া ও জলবায়ু-সহনশীল কৃষিরও প্রতীক।”
সফল সুপারি চাষিরা বলছেন, “প্রকৃতি কখনো শত্রু নয়, তাকে বুঝতে ও জানতে হয়। আগের মতো গাছ মরছে না। এখন সুপারির বাম্পার ফলন পাওয়া যাচ্ছে।”
উখিয়া-টেকনাফের গ্রামীণ অর্থনীতিতে সুপারি এখন হয়ে উঠেছে নতুন ভরসা। এলাকার পতিত জমি নতুনভাবে সুপারি বাগানে রূপান্তরিত হচ্ছে, আর পুরোনো গাছগুলো পুনরায় পরিচর্যা শুরু করছেন চাষিরা। এই লাভজনক ফসলের আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ ছাড়াও ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন উপকূলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ চাষি।